সাইমন কমিশন

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার যে সংস্কার আইন প্রবর্তন করেছিলেন তা উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয় । অসহযোগ আন্দোলনের তীব্রতা এবং স্বরাজ্য দলের কর্মসূচি ব্রিটিশ সরকারকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছিল । এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের দাবিদাওয়া ও অসন্তোষের মূল কারণগুলি অনুসন্ধান করে শাসনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন বা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটুটরি কমিশন বা ভারতীয় সংবিধানিক কমিশন গঠন করা হয়েছিল ।

সাইমন কমিশন গঠন

  • ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সরকার ও বিরোধীদলীয় সাতজন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত
  • ইংল্যান্ডের উদারনৈতিক নেতা ও প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ স্যার জন সাইমনের( Liberal Party ) নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হয়েছিল বলে এটি সাইমন কমিশন নামে পরিচিত । এর অন্যান্য সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন শ্রমিক দলের ( Labour Party ) এবং বাকি চারজন ছিলেন রক্ষণশীল দলের ( Conservative Party ) অন্তর্ভুক্ত।
  • সাইমন কমিশনের বিশিষ্ট সদস্যরা হলেন লর্ড স্ট্র্যাথকোনা, ভাইকাউন্ট বার্নহ্যাম, কর্নেল স্টিফেন ওয়েলিস, লেনফক্স, মেজর এটলি ও এডওয়ার্ড ক্যারোগান।
  • এই কমিশনের সাতজন সদস্যই শ্বেতাঙ্গ এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন ।

সাইমন কমিশন গঠনের কারণ

  • মন্ট ফোর্ড প্রস্তাব : মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের ( ১৯১৯ খ্রি. ) একটি ধারায় প্রস্তাব রাখা হয়েছিল , মন্ট ফোর্ড শাসন সংস্কারের বিভিন্ন ধারাগুলি কতটা কার্যকরী হল , তা অনুসন্ধানের জন্য দশ বছর পর এক কমিশন গঠন করা হবে । সেই প্রস্তাব অনুসারে সাইমন কমিশন গঠিত হয় ।
  • মন্ট ফোর্ড এর ব্যর্থতা : মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন প্রবর্তন করে ব্রিটিশ আশা করেছিল , সফলভাবে ভারতবাসীকে জাতীয় আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা যাবে বা ভারতীয়দের ক্ষোভকেও অনেকটা প্রশমিত করা যাবে । কিন্তু তা না হয়ে উলটে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ক্ষোভ চরমে পৌঁছােয় । ফলে ব্রিটিশ সাইমন কমিশন গঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে ।
  • নির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্য : ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস বহু সমস্যা অতিক্রম করে বড়ো ধরনের সাফল্য পেয়েছিল , যা সে সময়কার বড়ােলাট লর্ড আরউইনকে ভীত করে তােলে ।
  • স্বরাজ্য দলের প্রস্তাব : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্বরাজ্য দল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সরকারের কাছে কেন্দ্রীয় আইনসভায় শাসন সংস্কার করার জন্য এক গােলটেবিল বৈঠক ডাকার প্রস্তাব রাখে ।
  • মুসলিম লীগের দাবি : মুসলিম লীগ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে শাসন সংস্কারের জন্য স্বরাজ্য দলের অনুরূপ একটি দাবিপত্র সরকারের কাছে পেশ করে । সাইমন কমিশন গঠনের পেছনে এই ঘটনাটিরও প্রভাব ছিল ।
  • ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন : ভারত সচিব লর্ড বার্কেনহেড ছিলেন রক্ষণশীল দলের সদস্য । তিনি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে , ১৯২৯ – এর ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তার রক্ষণশীল দল ( Conservative Party ) – কে হারিয়ে শ্রমিক দল ( Labour Party ) জয়লাভ করবে ও শাসকরূপে ব্রিটেনে ক্ষমতায় আসবে । তাঁর পরামর্শে পরাজয় এড়াতে তড়িঘড়ি এই কমিশন গঠন করা হয় ।
  • সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ : হিন্দু – মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চলাকালীন সাইমন কমিশন গঠন করতে চাওয়া হয়েছিল । কারণ তা হলে কমিশন তার প্রতিবেদনে এই দাঙ্গার চিত্র তুলে ধরতে পারবেন যা ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে ।

অসন্তোষের কারনঃ

  • কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য না থাকায় সেখানে ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া প্রতিফলিত হবে না।
  • ভারতীয়দের শাসনতান্ত্রিক যোগ্যতা বিচার করবে একটি অ-ভারতীয় কমিশন, তা ভারতের পক্ষে খুবই মর্যাদা হানিকর।

সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে ভারতীয়েদর আন্দোলন

  • কমিশনের সাত জনই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ । ভারতের শাসনতন্ত্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত সাইমন কমিশনের গঠন ও কাজের ধরন ছিল ভারতীয়দের কাছে জাতীয় অপমান স্বরূপ । তাই ভারতীয়রা সাইমন কমিশন প্রত্যাখ্যান করে ।
  • ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি জন সাইমন সদলবলে বােম্বাই বন্দরে এসে পৌঁছেলে জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । ওইদিন সারা ভারতে হরতাল পালিত হয় । হাতে কালাে পতাকা ও ‘ Go back Simon ‘ লেখা প্রচারপত্রসহ সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় । অসংখ্য জনসভার মধ্যে বােম্বাইয়ের চৌপাটীর বালিয়াড়ির সমাবেশটি ছিল সবচেয়ে বড়াে ।
  • কাজী নজরুল ইসলাম সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নামে ব্যাঙ্গাত্বক একটি কবিতা লিখেন।
  • ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর, লালা লাজপত রায় সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনিতে অংশগ্রহণ করেন । সেখানে তিনি পুলিশের লাঠি চার্চে গভীর ভাবে আহত হন। গুরুতরভাবে আহত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘’আমার শরীরে করা ব্রিটিশের প্রহার, ব্রিটিশের ধংসের কারণ হয়ে উঠবে’’। ব্রিটিশের প্রহারে গুরুতরভাবে আহত হওয়ার ফলে ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
  • যুক্তপ্রদেশে ( বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ) মতিলাল নেহরুর পুত্র জওহরলাল ছাড়াও গােবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমুখ নেতা শােভাযাত্রা পরিচালনার সময় পুলিশের হাতে প্রহৃত হন ।
  • সাইমন কমিশন ভারতের যেখানেই গিয়েছে , সেখানেই প্রবল বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে । কলকাতায় যেদিন সাইমন সদলবলে উপস্থিত হন , সেদিন অরন্ধন ও ধর্মঘট পালিত হয় । সাইমন কমিশন বিরােধী বিক্ষোভের পুরােভাগে এগিয়ে এসে সেদিন দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ।
  • সাইমন কমিশন ভারতে আসেন ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। তখন ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড আরউইন (১৯২৬-১৯৩১)।
  • ব্রিটিশের বিভিন্ন নীতির সমর্থক ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন ও এক প্রস্তাব গ্রহণ করে সাইমন কমিশনকে সমালােচনা করে বলে — এই আইন ভারতীয় জনগণের প্রতি ইচ্ছাকৃত অপমান ( ‘ A deliberate insult to the people of India ‘ ) ।
  • ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সামাজিক , রাজনৈতিক , শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে অপমানজনক এই কমিশনকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন । এরই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে এক সর্বদলীয় সম্মেলনে প্রাক্তন স্বরাজ্যদলের নেতা মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটি কমিটির ওপর ভারতের নতুন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য মূল নীতিগুলির খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় । স্থির হয় , দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা করবেন দেশের নেতৃবৃন্দই ; কোনাে বিদেশি কমিশন নয় । এইভাবে সাইমন কমিশনকে সমস্ত দিক থেকেই অবজ্ঞা ও বর্জন করা হয় ।
  • সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন সারা ভারতে উত্তাল আকার ধারণ করলেও ব্রিটিশ সরকার এই সব প্রতিবাদে কোনো কর্ণপাত করেনি । এই কমিশন যথারীতি দেশব্যাপী সমীক্ষা চালায় ও এই অস্বস্তিকর পরিবেশে কমিশন তাঁদের অনুসন্ধানকার্য শেষ করে স্বদেশে ফিরে যান ।
  • দুবছর পরে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে মে কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় । রিপোর্টে সুপারিশ করা হয় অবিলম্বে সরকারের উচিত ভারতের সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা । এছাড়াও কিছু কিছু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তনেরও সুপারিশ করা হয় ।
  • সাইমন কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয় ।